প্রবন্ধ রচনা: সমাজসেবা। Social service।
সমাজসেবা ও মানবসেবা
অথবা
সমাজসেবার প্রয়োজনীয়তা
অথবা
জনসেবা।
সমাজসেবা। মানবসেবা। জনসেবা। Social Service. |
ভূমিকা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে মানুষের করা প্রথম প্রতিষ্ঠান। পরস্পর নির্ভরশীলতা ছাড়া মানুষের সামাজিক জীবন সুখকর হতে পারে না। সেজন্য কোন সামর্থ্য মানুষ যদি তার কল্যাণের হাত প্রসারিত না করে তাহলে মানুষের জীবন থেকে দুঃখ বেদনা দূর হতে পারে না। জীবনের সুন্দর বিকাশের জন্য মানুষ একে অপরের সহায়তার প্রত্যাশী। আবার নিজের স্বার্থ সমাধানের জন্য মানব জীবনের সার্থকতা নিহিত রয়েছে। মহৎ মানুষ সেই ব্যক্তি যিনি নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে পরের উপকারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। মানব চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য থেকে সমাজসেবার প্রবণতা এসেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ একদিন সমাজ গড়েছিল এবং এখনো তারা সমাজ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তাই সমাজসেবা আমাদের প্রধান কর্তব্য।
সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য
সৃষ্টির প্রথমে মানুষ খুবই অসহায় ছিল। বন্যজন্তুর ভয়ে সবসময় তাদের ভীত থাকতে হতো। কিভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হয় তা তাদের জানা ছিল না। তারা পর্বতের গুহায় কিংবা গাছের শাখায় বাস করত। নিজের আহারের সন্ধানে বের হয়ে অনেক সময় তারা বন্যজন্তুর শিকারে পরিণত হতো। তবে মানুষকে আল্লাহ বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে পৃথিবীতে পয়দা করেছিলেন। তাদের সমস্যার সমাধান তারা নিজেরাই একদিন করে নিল। বন্য হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার জন্যই মানুষ সমাজবদ্ধ হলো এবং সৃষ্টি করল সমাজ। সমাজ গড়ে তুলে মানুষ সব জীবজগতের উপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করল এবং ধীরে ধীরে তারা গোটা পৃথিবীর মনিব হয়ে বসলো। মানুষক কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব একজনের প্রয়োজনে অপরকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীতে সুখী সমাজ গড়ে তুলতে হলে এটি একান্ত প্রয়োজন।
সমাজসেবার তাৎপর্য
সমাজ বলতে একটি বিশেষ গণ্ডির জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। কিছুসংখ্যক লোককে নিয়ে গড়ে ওঠে সমাজ। বিশেষ গণ্ডিভুক্ত মানুষকে নিয়ে গঠিত সমাজের কল্যাণকর্মই সমাজসেবা। সমাজসেবা বলতে সমাজের অন্তর্গত মানুষের নানা ধরনের কল্যাণ কাজ বোঝায়। এদিক থেকে সমাজসেবার সঙ্গে সমাজসেবার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য যে কাজ তা জনসেবা বলে বিবেচিত হতে পারে। সমাজ সেবা সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার সমস্যা পৃথক, সমাধানের উপায় ও একরকম নয়। সমাজের সমস্যা নিরসন করে সেখানকার মানুষের কল্যাণওই সমাজসেবা।
সমাজসেবার প্রয়োজনীয়তা
সমাজে নানা ধরনের লোকজন বসবাস করে। তাদের নানা সমস্যা থাকে। এসব সমস্যার সমাধানের ক্ষমতা এককভাবে কারোও নেই। সামাজিক কুসংস্কার, অর্থনৈতিক সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত সমস্যা, নিরক্ষরতা, যাতায়াতের সমস্যা, ধর্মের অজ্ঞতা, স্বাধিকার চেতনার অভাব ইত্যাদি ধরনের সমস্যায় আজ সমাজ পরিপূর্ণ। এসব সমস্যা থেকে রেহাই না পেলে সমাজে মানুষের দুর্গতির শেষ থাকে না। তাদের উন্নতির পথ বন্ধ থাকে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক এর অবদান থাকা প্রয়োজন। পরোপকারী মানুষ সমাজের এসব সমস্যা দূর করে সেখানে সুন্দর সমাজ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
সমাজ ও ধর্ম
ব্যক্তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য একদিন সমাজ গড়ে উঠেছিল। আবার ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ধর্ম মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। তবে সমাজকে বাদ দিয়ে কখনো ধর্ম তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। পৃথিবীতে আগে সমাজের সৃষ্টি হয়েছে এবং তারপর এসেছে ধর্ম। তাই সমাজসেবা করলেই ধর্মের বিধানগুলো পুরোপুরি পালন করা হয়ে যায়। প্রত্যেক ধর্মেই বলা হয়েছে অন্যের হক নষ্ট করা যাবে না এবং ধনী-গরীব, অন্ধ-আতুর, দুস্থ-কাঙ্গাল, শত্রু-মিত্র, নির্বিশেষে সব মানুষের সেবা করতে হবে। এটি মূলত সমাজসেবারই আদর্শ। দিনরাত মসজিদে বসে আল্লাহর নাম জিকির করতে হবে, ধর্ম এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেনি। বরং দিনে মাত্র পাঁচবার মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করে পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীর সেবায় অর্থাৎ সমাজের নিয়োগ করতেই ধর্ম মানুষকে নির্দেশ দিয়েছে। কারো ঘরে খাবার থাকলে সে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রাখতে পারবে না। ধর্ম বারবার এ কথার উপর জোর দিয়েছে। অতএব সমাজসেবাই যে ধর্মের গোড়ার কথা তাতে এই কথাটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
সমাজসেবা ও ছাত্রসমাজ
যখন সমগ্র সমাজ থাকে অজগর নিদ্রায় নিমগ্র তখনই ছাত্রসমাজের ঘুম ভাঙ্গে। যুগে যুগে ছাত্র সমাজের ইতিহাসে রয়েছে তার উজ্জ্বল স্বাক্ষ্য। সমাজের অন্যায় অসত্য ও প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের চিরন্তন সংগ্রাম। যেখানে ব্যথা-বেদনার হাহাকার, আর্ত-পীড়িতদের ক্রন্দন রোল, সেখানেই ছাত্র সমাজের নির্ভীক উপস্থিতি। সবুজ, সতেজ ছাত্রসমাজ জাতির সবচেয়ে বলিষ্ঠতম অংশ। নবীন প্রাণ শক্তি অফুরন্ত উচ্ছ্বাসে ভরপুর তাদের দেহ মন, হৃদয়ে তাদের অসীম দুঃসাহস বাহুতে নবীন বল। তাদের চোখে উদ্দীপনার জ্বলন্ত মশাল বুকে অসম্ভবকে চ্যালেঞ্জ করার দুর্জয় প্রতিশ্রুতি। প্রাণ প্রাচুর যে ভরা এই তরুণ দল জাতির অসীম শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক। সামাজিক স্বাধীনতা প্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে জীবন বলিদান এর জন্য তারা চির অঙ্গীকারাবদ্ধ। সামাজিক শক্তির এই সবচেয়ে সতেজ অংশটি বিকাশের যথাযোগ্য সুযোগ লাভ করলে বহু অসাধ্য সাধিত হতে পারে, সামাজিক কল্যাণের বহু রুদ্ধদ্বার উদঘাটিত হতে পারে। বাংলাদেশের মতো গরীব দেশে যেখানে সাধারণ মানুষের দুঃখ দারিদ্র্যের অন্ত নেই, নিরক্ষরতা ও অশিক্ষা কুশিক্ষায় শুষ্কতাপে যেখানে নিরানন্দ মরুভূমি তার স্থায়ী আসন পেতে বসেছে, সেখানে রোগ তাপ জর্জরতায় এবং প্রাকৃতিক দৈব দুর্বিপাকে লাখ লাখ মানুষের জীবন প্রতিবছর বিপন্ন ও অসহায় হয়ে পড়ে সেখানে ভূমিকা অসামান্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো নিরক্ষরতা প্রীত দারিদ্র জর্জর, রোগ জর্জর, সমস্যা জর্জর, দেশে ছাত্রসমাজের সামনে পড়ে আছে সমাজসেবার বিস্তীর্ণ প্রান্তর। প্রকৃতির নিষ্করন রুদ্রশাপে এদেশের মানুষের দুঃখ দূর্গতির অন্ত নেই। বন্যা প্লাবন জলোচ্ছ্বাস এবং ভূমিকম্প ঘূর্ণিবার্তা ধ্বসের ফলে প্রতিবছরে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য ঘনিয়ে আসে দুঃখের অমারাত্রি। এসব ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ স্বেচ্ছাকৃতভাবেই অনেক সময় সমাজ সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুঃখ সঙ্কটের আবর্ত মাঝে নিজেদের নিক্ষেপ করে তারা বিপন্নের উদ্ধারে রচনা করে আত্মত্যাগের নতুন ইতিহাস।
সমাজসেবার পদ্ধতি
সমাজসেবার জন্য নানারকম পদ্ধতি রয়েছে। সমাজ সমস্যার প্রকৃতির সঙ্গে এই পদ্ধতির সংযোগ আছে। যেখানে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেখানে তা করা উচিত। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় এবং পল্লীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকম সেবা সংগঠন করে তার মাধ্যমে জনসাধারণের সেবা করা যেতে পারে। এসব সংঘের সভ্য হয়ে যুবক-যুবতীরা নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করতে পারে এবং দোস্ত লোকের সেবা করতে পারে। নিরক্ষরতার সামান্য মোকাবেলায় গণশিক্ষা কেন্দ্র খুলতে হবে। সেখানে আর্থিক সমর্থন দরকার। আবার নিজের শ্রম দেওয়া যেতে পারে। স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে সমাজের অনেক উপকার করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে শুধু বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সমাজের কল্যাণ আনয়ন করা সম্ভব। আর্থিক বা বিভিন্ন সেবা দ্বারা সমাজের মঙ্গল করা যেতে পারে। সমাজের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করলে তাতে বেশি উপকার হয়। এতে একদিকে যেমন সমাজের উপকার হয় অন্যদিকে তেমনি সেবায় আনন্দ পাওয়া যায়।
সমাজসেবার উপকারিতা
সমাজসেবার মাধ্যমে মানুষের তথা সমাজের অনেক উপকার সাধন করা যায়। সমাজের দুঃখ দুর্দশা মোচনের জন্য সমাজসেবীরা কাজ করে থাকে। যেসব সমস্যা সমাজের বসবাসরত মানুষ সমাধান করতে পারে না সেসব সমস্যা সমাজসেবীরা দূর করতে সাহায্য করে। এতে সমাজ সমস্যা মুক্ত হয়। সমাজে বসবাস আনন্দদায়ক হয়। সমাজ এগিয়ে যায় উন্নতির দিকে। তাই সবার মধ্যে সেবামূলক মনোভাব গড়ে ওঠা দরকার।
উপসংহার
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান করেছে এবং আরো নানারকম সুবিধা ভোগ করার সুযোগ দিয়েছে। নিজের স্বার্থে মগ্ন থাকাই জীবন নয়। পরের কারণে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে আনন্দ নিহিত। অতএব সমাজের কল্যাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা আমাদের প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য।
Post a Comment for "প্রবন্ধ রচনা: সমাজসেবা। Social service। "