বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দল ও বিরোধী দলের করণীয়
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এদেশের ইতিহাসে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়। তারপর কিছু সময়ের জন্য এর অব্যাহত ধারা বাধাগ্রস্ত হয়। অবশেষে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান দুই অংশ হিসেবে সরকারি ও বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের করণীয় ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
![]() |
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দল ও বিরোধী দলের করণীয় |
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দল ও বিরোধী দলের করণীয়সমূহ
নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলকে সরকারি দল এবং সংখ্যালঘু দলকে বিরোধী দল বলে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সরকারি দল যেমন দরকার তেমনি বিরোধী দলও দরকার। সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ে মিলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলে। নিচে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দল ও বিরোধী দলের করণীয়সমূহ তুলে ধরা হলো-
(ক) বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দলের করণীয়
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সাফল্যের ক্ষেত্রে সরকারি দলের করণীয়সমূহের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা সরকারি দলই দেশের সকল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সরকারি দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণেই তা পরিচালিত হয়। নিচে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দলের করণীয়সমূহ আলোচনা করা হলো-
১. আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ
বাংলাদেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকারি দল গণতন্ত্রের সাফল্যকে অর্জন করতে পারে। তাই আইনসভার সাথে জনগণের সুসম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করা সরকারি দলের অবশ্যই করণীয়।
২. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রদান
যে দেশের গণমাধ্যম (রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রভৃতি) যত বেশি স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে সে দেশের গণতন্ত্রের সাফল্য তত বেশি। তাই বাংলাদেশের সরকারি দলকে সকল প্রকার গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে। এটি তাদের অবশ্যই করণীয়।
৩. নিয়মিত ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান
গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য নিয়মিত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান খুবই জরুরি, বাংলাদেশের সরকারি দলকে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য তাদের করণীয় হিসেবে তাই অবশ্যই নিয়মিত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে।
৪. বিরোধী দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য অবশ্য করণীয় হিসেবে সরকারি দলকে সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে।
৫. নমনীয় মনোভাব
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দলকে অবশ্যই করণীয় হিসেবে বিরোধী দলের প্রতি তাদের নমনীয় মনোভাব দেখাতে হবে। কারণ সরকারি দলের সহিষ্ণু মনোভাব পোষণ গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জরুরি।
৬. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সরকারি দলকে জনগণের নিকট স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি সরকারি দলের জন্য অবশ্যই করণীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
(খ) বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দলের করণীয়
বাংলাদেশে বিরোধী দল 'ছায়া সরকার' বা 'বিকল্প সরকার' হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ দেশে বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত থেকে সরকারি দলের বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরার মাধ্যমে দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যায়। নিচে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দলের করণীয়সমূহ আলোচনা করা হলো
১. গঠনমূলক সমালোচনা
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দলের অবশ্য করণীয় একটি কাজ হলো সংসদে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা। এক্ষেত্রে বিরোধী দল সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো জনগণের সামনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকাশ করতে পারে যা গণতন্ত্রের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
২. জনমত গঠন
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দলকে অবশ্যই করণীয় হিসেবে জনমত গঠন করতে হবে এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সংহতি রেখে নীতি ও কর্মসূচি পেশ করতে হবে। কারণ জনমত গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই জরুরি।
৩. জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে ও উন্নত করার জন্য বিরোধী দলকে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাতে হবে। যা দেশের জন্য কল্যাণকর। এক্ষেত্রে সরকারি দলকে বিরোধী দলের বিরোধিতা সহ্য করার মতো ধৈর্য ও পরিপক্বতা অর্জন করতে হবে।
৪. সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ
সরকার যাতে কোনো কিছুতে স্বেচ্ছাচারী না হতে পারে এজন্য বিরোধী দলকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে এবং সরকারের ভুল-ত্রুটিকে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বিরোধী দল কর্তৃক এ দায়িত্ব অবশ্যই করণীয়।
৫. বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দল কর্তৃক বিরোধিতার জন্য শুধুমাত্র বিরোধিতা করা এ ধ্যান-ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। সরকারের যেসব কাজকর্মে জনকল্যাণ নিহিত বিরোধী দলকে সেক্ষেত্রে সরকারকে সমর্থন জানাতে হবে। তাহলে সরকারি দল বিরোধী দলের দাবি বাস্তবায়ন করতে উৎসাহী হবে। যা গণতন্ত্রের বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে।
৬. সংসদীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সংসদীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা বিরোধী দল কর্তৃক অবশ্যই করণীয় অন্যতম একটি কাজ। বিরোধী দলকে সংসদ বর্জন করা চলবে না। সংসদে উপস্থিত থেকে আলাপ-আলোচনা, বিতর্কের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাহলে দেশের গণতন্ত্রায়ন ঘটবে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কার্যকরী করতে সরকারি দল ও বিরোধী দলকে পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। উপর্যুক্ত করণীয়সমূহের মাধ্যমে উভয় দলই দেশের গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারে যা দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এজন্য সংসদে একে-অন্যের বিরোধিতা করা বন্ধ করে আপোষকামী মনোভাব নিয়ে কোনো বিষয়ের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। তাহলেই সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হবে। তখন সংসদই হবে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু যা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।